উত্তর-আধুনিক শিল্প/উত্তর-আধুনিক অশিল্প || সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম|| মানসলোক ||
































উত্তর-আধুনিক শিল্প/উত্তর-আধুনিক অশিল্প




সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম

















১.ক.
উত্তর-আধুনিকতা নিয়ে লেখার একটা বিপদ আছে : বিপদটা হল এই যে, উত্তর-আধুনিকতার কোনাে
নির্দিষ্ট, পাঠক/গবেষক-বান্ধব এবং সর্বজনগ্রহণযােগ্য সংজ্ঞা নেই। সে রকম সংজ্ঞা সংসদীয় গণতন্ত্র
অথবা ত্রিভুজ-চতুর্ভুজ অথবা কাঠালচাপার হতে পারে : বস্তুত আধুনিকতা, একটা সময়ে (সাড়ে উনিশ
শতক পর্যন্ত) এরকম সংজ্ঞাচর্চায় তুপ্তি পেত। এর পর থেকে, বক্ষ্যমান প্রবন্ধে আমরা লক্ষ করব, তিনটি
ওলটপালট ঘটনার পর থেকে (সেগুলাের উদ্যোক্তা ডারউইন, মার্ক্স ও ফ্রয়েড), এবং নগরায়ন,
যান্ত্রিকায়ন, গণ-উৎপাদন ইত্যাদির প্রভাবে আধুনিকতার সংজ্ঞানির্ভরতা হ্রাস পায়। কারণ, ব্যক্তির
মনের ভিতরে, তার অস্তিত্বের অন্দরমহলে শিল্পী-সাহিত্যিক-সমাজচিন্তকের দৃষ্টি পড়তে থাকলে দেখা
গেল ব্যক্তিটিকে অ্যানাটমির সহজপাঠ দিয়ে আর সংজ্ঞায়িত করা যাচ্ছে না। ইয়রিকের করােটি হাতে
হ্যামলেট যে মানবসম্পর্কিত একটি দুর্ধর্ষ কবিতা আবৃত্তি করেছিল তাতে যে অনিশ্চয়তার এবং সন্দেহের
বীজ ছিল, কুড়ি বা সােয়া কৃড়ি শতকে তা মহীরূহে পরিণত হল।
যেখানে আধুনিকতাই সংজ্ঞা নিয়ে বিব্রত পর্যন্ত, সেখানে উত্তর-আধুনিকতার অবস্থাটা কল্পনা করা
যায়। তবুও কোনাে একনিষ্ঠ পণ্ডিত যদি একটি সংজ্ঞা নির্ধারণও করেন, উত্তর-আধুনিকতার দেবতারা
অলক্ষ্যে বসে মুচকি হাসবেন (উত্তর-আধুনিকতা বহুবচনধর্মী : বহুকেন্দ্রিকতায় তা বিশ্বাসী, সেজন্য
দেবতাদের ক্ষেত্রে এই বহুবচনের প্রয়ােগ)। উত্তর-আধুনিক চেতনা (বা চেতনাসমূহ) এই সংজ্ঞায়নের
বিরুদ্ধে। সংজ্ঞা নেই: প্রধান পুরােহিত/পণ্ডিতদের মাথা ঝাঁকানাে ঐকমত্য নেই। তাহলে কী আছে?
আছে সমগ্রের বদলে অংশ, আস্ত ধারণার পরিবর্তে খণ্ড-ধারণা, আছে বিভ্রান্তি। মনে পড়ে, বছর তিনেক
আগে ইউরােপের একটি শহরে উত্তর-আধুনিকতা সংক্রান্ত একটি সেমিনারের একটি সভায় পৌরহিত্য
করতে হয়েছিল আমাকে। এক তরুণ গবেষক উত্তর-আধুনিক সঙ্গীত নিয়ে প্রবন্ধ পড়তে গিয়ে বারে
বারে খেই হারিয়ে ফেলছিলেন।
আমি সময়ের সীমাবদ্ধতার কথা তাকে স্মরণ করিয়ে দিলে গবেষক ক্লান্ত স্বরে অভিযােগ করছিলেন ক.
এই খেই হারানােই তাে উত্তর-আধুনিকতা ; এবং খ. সময়ের কেন্দ্রিকতার বিরুদ্ধেই তাে সময়সমূহের
আখ্যান। তার কথায় সত্য ছিল, যদি ও তার খেই হারানাের ব্যাপারটা এভাবে ধােপে টিকিয়ে দেয়ার
প্রচেষ্টা আমার মনঃপূত হয়নি। সভাপতির বক্তব্যে আমি তাকে অ্যান্ড্ গুডউইনের 'পপুলার মিউজিক
আন্ড পােস্টমডার্ন থি ওরি থেকে একটা উদ্ধৃতি দিয়ে জানিয়েছিলাম-সব উত্তর-আধুনিকতা যেমন শিল্প
নয়, শিল্প হওয়ার কিছু শর্ত আছে, যার অবস্থান খেয়াল-খুশির নাগালে হলেও সেজন্য একটু পরিশ্রম
প্রয়ােজন, সে রকম সব খেই হারানােই উত্তর-আধুনিক ডিসকোর্স নয়। ইত্যাদি।
কথাটি তারও মনে ধরেছিল। আধুনিকতার উপর সেমিনার হলে এটি হত না। আমিও পৌরহিত্যে রাজি
হতাম না ; রাজি হলেও চুপ করে বসে থাকতাম। আধুনিকতার গবেষক পণ্ডিতেরা গুরুগষ্টীর হন,
দেখেছি। লেখকরাও। টি এস এলিয়টের দি ওয়েস্ট ল্যান্ড' পড়ে দেখুন। মানুষ যনত্র। মানুষের আন্মার
মৃত্যু হচ্ছে। মানুষের আত্মা পিপাসার্ত। মানুষ নির্বাণ চায়। পড়তে পড়তে আপনার মনে হবে, আপান
আমি
মহাপাতক।
আসলে কি আমরা মহাপাতক? আমি কি নির্বাণোন্মুখ কোনাে প্রাণী? বিচ্ছিন্নতা, একাকীত্ব কি আমার খুব
খারাপ লাগে? আর যদি আত্মাতেই বিশ্বাস না করি, তাহলে আত্মিক বিশুদ্ধতাটা কী এবং আত্মার
ব্যক্তি
মুক্তিটাই বা কী এ প্রশ্নও তাে ওঠে। উত্তর-আধুনিকতা ব্যক্তির স্বাধীনতাকে বাড়ায় এবং বড় কথা,
বলতে যে ইউরােপীয় আলােক-যুক্তিকাল বা এনলাইটেনমেন্ট প্রবর্তিত সম্পূর্ণ বা কেন্দ্রীভূত মানুষের
ধারণা বােঝায়-যার উৎপত্তি রেনে দেকার্তের সেই বিখ্যাত cogito ergo sum (আমি ভাবি, অতএব
আমি আছি) চিন্তায়-সেটি উত্তর-আধুনিকতা স্বীকার করে না। সে বলে, ব্যক্তি নিজে যা, তা-ই; ব্যক্তি
অনেকগুলি অবস্থা ও অবস্থান; অনুভূতি/ভাব; যুক্তি/যুক্তিহীনতা; প্রবৃত্তি; স্থানীয় সংস্কৃতি; সময় ও
ইতিহাসের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ফল; হয়তাে এসবের সমষ্টিও, যে-সমষ্টিকে একক একটি অংকে পরিমাপ
করা যায় না।
সেমিনারের তরুণ গবেষক সন্ধ্যায় বিয়ার খেতে খেতে জিজ্ঞেস করল, তার বিভ্রান্তিটা কি মৌলিক বলে
প্রতীয়মান হয়েছে শ্রোতাদের কাছে? আমি উত্তরে উত্তর-আধুনিকতার অন্যতম গুরু লিওতার সঙ্গে
ইউর্গেন হাবেরমাসের দ্বন্দ্বের প্রসঙ্গটা তুললাম, এবং জানালাম : হাবেরমাস যে-আধুনিকতার জন্য
ওকালতি করেছেন তা যদি যুক্তিবাদকে সত্য বলে গ্রহণ করে, তাহলে আধুনিকতার ভিতরে যে একটি
বিধ্বংসী এবং নৈরাজ্যমূলক প্রবৃত্তি আছে, তাকে কিভাবে তা মেনে নিবে? আর লিওতার উত্তর-
আধুনিকতা যদি সকল মেটান্যারেটিভ বা মহা-আখ্যানকে অবিশ্বাস করে, তাহলে সেই অবিশ্বাস সমন্ধে
একটা ঐকমত্যে পৌঁছার প্রক্রিয়াকেই তাে তাকে অবিশ্বাস করতে হয় প্রথমে? গবেষককে আমি আরাে
জানালাম, তার বিভ্রান্তি মৌলিক কি অমৌলিক, এটি একটি আধুনিকবাদী প্রশ্ন; উত্তর-আধুনিকতায়
'মৌলিক' বিষয়টিই তাে প্রশ্নসাপেক্ষ।
সেদিন সকালেই কোনাে এক প্রবন্ধে কথাগুলা পড়েছিলাম। আমি উদ্ধৃতি দিলাম, বস্তুত। এবং এই
উদ্ধৃতি দেয়া, এই নানা জায়গা থেকে কথা নিয়ে জোড়াতালি দেয়া, এই ব্রিকোলাজ, এই পাঁচমিশালী বা
প্যাস্টিশ উলে আধুনিকতার একটি উপাদানও বটে।
১.খ
উত্তর-আধুনিকতা নিয়ে লেখার দ্বিতীয় একটা বিপদও আছে। সেটা এখন বলি। কিছুদিন থেকে-গত
দশ বছর ধরেই বস্তুত-আমি বাংলাদেশের চিত্রকলা নিয়ে লেখালেখিতে উত্তর-আধুনিক কথাটি ব্যবহার
করে আসছি। আমি বলেছি, শিশির ভট্টাচার্য (এবং সময় গ্রুপের দু-এক শিল্পী): ঢালী আল মামুন,
নাজলী লায়লা মনসুর, রুহুল আমীন কাজল প্রমুখ আশির দশকের শিল্পীরা এক ধরনের উত্তর-
আধুনিকতার চর্চা করছেন। আশির দশকটি ছিল লে. জে. হু. মু. এরশাদের সামরিক
শাসনের/স্বৈরশাসনের দশক এবং সামরিক শাসন মানেই অতিশয় কেন্দ্রিক, অতিশয় অনড়, অতিশয়
ব্যক্তি-বিরােধী শাসন। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল রাজনীতির গরুর হাটের বিকিকিনি। গায়ে দাম লেখা
কাগজ সেটে জড়াে হয়েছিল যেখানে রাজাকার আর এককালের বাম রাজনীতিবিদরা (বাম রাজনীতিও
যখন প্রাণহীন তাত্বিকতায় পর্যবসিত হয়, তাহলে সেটি ও হয়ে দাঁড়ায় অতিশয় কেন্দ্রিক, অনড় এবং
প্রগতি বিরােধী, যদিও এর সঠিক চর্চা হলে ব্যক্তিরই মঙ্গল হয়, শ্রমিক কৃষক মেহনতি মানুষের ভাগ্য
या। কিছু বাম রাজনীতির কোথায় সঠিকভাবে চর্চা হয়েছে? এককালীন সোভিয়েত ইউনিয়নে?
ভারতে? বাংলাদেশে? বাম রাজনীতির আদর্শই বা আজ কোথায়? বাম রাজনীতির উত্তর-আধুনিকতার
সর ধরে কি বলা যায় না, আদর্শ নামক কেন্দ্রীভূত চেতনাটি আসলে মানুষের খণ্ড খণ্ড স্বপ্নেরই সমষ্টি?
তাহলে সেই খন্ড নিয়ে ব্যস্ত হলে কেমন হয়? খণ্ডগুলােতে আলাে আছে, অন্ধকার আছে, তৃপ্তি-অতৃপ্তি
আছে: সয়ে নেয়ার, মানিয়ে নেয়ার বিষয় আছে-সমগ্রতে, সেটা আদর্শতে-তা অনুপস্থিত।)
প্রতিষ্ঠানের প্রস্তাবিত আদর্শ একটি আধুনিক মেটা চিন্তা, তার সঙ্গে খাপ খাইতে গিয়ে মানুষের পা
ফসকে যায়। তাই বলে আদর্শকে উত্তর-আধুনিকতা অস্বীকার করে না, বিশেষ করে ব্যক্তির আদর্শ,
যাতে ভুল-ভ্রন্তি থাকতে পারে, কিন্তু যার দায়-দায়িত্ব ওই ব্যক্তিরই। কিন্তু আদর্শ থাকবে আদর্শ
হিসেবেই, তাতেই তার পরিচিতিটা সম্পূর্ণতা পায়; কিন্তু সেটি কোনাে গ্রুপ বা ব্যক্তি বাস্তবে প্রয়ােগ
করতে গেলেই বাঁধে সমস্যা।
এই দীর্ঘ পথবিচ্যুতি মার্জনীয়। এটিও এক ধরনের উত্তর-আধুনিকতা। ধান ভানতে শিব গীত তুল্য।
শিশির এবং অন্যান্যরা সেই অন্ধকার, বুকের উপর-চেপে বসা সময়ে তাদের ক্যানভাসে শুদ্ধ
চিত্রকরসুলভ গুণের পরিবর্তে লেখক সুলভ গুণের সমাবেশ ঘটালেন। তাতে একটি ভিন্ন আখ্যানের
আবির্ভাব ঘটল। আখ্যানটা সময়কে নিয়ে। সেই আখ্যানে আসলাে প্যারডি, প্যাস্টিশ, আয়রনি। তারা
কেন্দ্রকে ভাঙলেন, বৃহৎ ব্যক্তির মুখােশ খুলে তার ক্ষুদ্রতাকে দেখালেন। কর্মকে ইচ্ছেমতাে খেলালেন।
আতিয়া ইসলাম এ্যানি যেমন তার কাজে অসাধারণ ব্রিকোলাজের পরিচয় দিয়েছেন (তাঁর 'হঠাৎ
একদিন' ছবিতে মােনালিসা তসবিহ হাতে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে, নিচে এক মােল্লা তার দিকে কামুক
দৃষ্টিতে তাকিয়ে-এই সংস্থাপনকর্মে ধর্মব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে একটা স্যাটায়ার প্রচ্ছন্ন) সে রকম,
আগে, শিশির-ঢালী-নাজলীরা সমাজের অসঙ্গতিসমূহ, ধর্ম-ব্যবসায়, রাজনীতি ব্যবসায়, সামরিক শাসনে
এবং স্বৈরশাসনে রুদ্ধ সময়ের নানাবিধ স্থলন-পতনকে উত্তর-আধুনিকতার নানা উপাদানে তুলে
আনলেন। এ্যানির কথাটা তুললাম এই জন্য যে, 'হাই আর্ট' (দাভিঞ্চি) এবং স্থানীয়/জনপ্রিয়/ব্রাত্য
শিল্পের উপাদানের সংস্থাপন, প্যারডি, অসঙ্গতি, হেত্বাভাস, প্যারাডক্স-এসবের চর্চায় এখনাে যে শিল্প
সৃষ্টি হচ্ছে এ্যানির (এবং আরাে সাম্প্রতিক সময়ের অনেকের) কাজ তা প্রমাণ করে। কিন্তু আশির দশক
থেকেই ছবিতে (প্রতি) আখ্যানের উপস্থাপনা শুরু হয়, এবং তাতে পূর্ববর্তী ইউরােকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি
থেকে উদ্গাত চিত্রকলার ভিজুয়াল বা দৃশ্যনির্ভর (যদিও তাতে চিন্তা বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছিল অনেকের
কাজে) কাঠামাে নির্মাণের পরিবর্তে ঝোক গেল আখ্যান বা ন্যারেটিভের দিকে। ঢালীর বেহুলা সিরিজের
(তরুণ ঘােষও বেহুলা নিয়ে কাজ করেছেন, তবে তিনি বেহুলার সংস্কৃতিগত এবং মীথনির্ভর ব্যাখ্যাটাকে
প্রাধান্য দিয়েছেন) অথবা শিশিরের খেলা দেখে যান বাবু সিরিজের কথাই ধরা যাক। এখানে আখ্যানটি
যুগের, যুগের ভাবমূর্তির, যাকে ভিতর থেকে তারা ভাঙেন। একটা স্থির স্থাপনায় যদি পরিণত হয় ওই
ভাবমূর্তি, তাহলে বিপদ। সেজন্যই এই ভাঙন (শিশিরের ছবিতে মানুষের খণ্ডিত হাত-পা ভাসে
শূন্যতায়)। তবে এই উত্তর-আধুনিকতাকে আমি সরল' আধুনিকতা বলব না। কারণ আমাদের সমাজে
ভােক্তা সংস্কৃতি ওই পর্যায়ে যায়নি, যা ওই রকম সরলতাকে অনিবার্য করে তৃলবে; অথবা আধুনিকতার
প্রকাশটিও দৃঢ়বদ্ধ একটি মাস্টার কোড-এ পরিণত হয়নি, যাকে ভাঙতে উত্তর-আধুনিকতার সবগুলাে
উপাদানের সমাবেশ ঘটাতে হবে। পারিভাষিক বর্ণনায় তাকে দুর্বল বলাই সঙ্গত : অর্থাৎ আধুনিকতার
কোনাে কোনাে উপাদানের সঙ্গে তার বিরােধ; সমগ্র ধারণাটির সঙ্গে নয়।
কিন্তু আমার এই উত্তর-আধুনিকতা চিহ্নিতকারীর নিরীহ ভূমিকাটি নিয়ে একজন শিল্পী একবার প্রশ্
তুলেছিলেন। একটি লেখায় তিনি এ রকম জিজ্ঞাসা রেখেছিলেন যে, উত্তর-আধুনিকতা আবার কা
জিনিস। "উত্তর যদি পরবর্তী অর্থে ব্যবহৃত হয়, তাহলে 'আধুনিকতা-পরবর্তী কথাটা কিভাবে বলা
गाয়? আজকেই কি আমরা আগামীকালে চলে গেছি নাকি? তিনি বলাবাহুল্য. 'উত্তর-আধুনিকতা
কথাটাকেই ভুল ব্যাখ্যা করেছিলেন। আমি ওই অভিযােগের উত্তর দিতে পারতাম, কিন্তু দেইনি, কারণ
বিভ্রান্তিটা বড় হলে ও, থাকা ভাল। উত্তর-আধুনিকতা সত্য ও সুন্দর-এর ক্লাসিক অবস্থান ও ব্যাখ্যাকে
প্রশ্ন করে, অনেকটা সেই মস্করাপ্রিয় পাইলটের মতাে, ফ্রান্সিস বেকন (শিল্পী নন, লেখক) তার অফ
টু্ প্রবন্ধে যাকে উল্লেখ করেছেন, যে প্রশ্ন রাখল, "সত্য কী? এবং উত্তরের জন্য অপেক্ষা করল না।
উত্তর-আধুনিকতার নিজস্ব একটি কোনাে সত্য নেই, আছে সত্যরা এবং সেগলােও আপেক্ষিক তার
সৌন্দর্যরাও আপেক্ষিক। অভিযােগকারী শিল্পীর কাজ আমার খুব পছন্দ: ব্যক্তি হিসেবে তাকে আরাে
বেশী; সাক্ষাতে আমি তাঁকে বলেছি, আসলে উত্তর-আপনিকতা কোনাে সময়-বিচার নয়; এর উত্তর
খণ্ডটি সময় নির্ণায়ক নয়, প্রবণতা নির্ণায়ক। উত্তর আধুনিকতা হচ্ছে কয়েকটি প্রবণতার নাম। সেজন্য
এটি আধুনিকতার উত্তর, সমসমায়িক, এবং প্রাক-ও। যদি ইউরোপীয় রেনেসাসকে আমরা আধুনিকতার
উৎপত্তি-কাল বলে মনে করি, তাহলে রেনেসাঁসে চিন্তা-ভাবনা, দর্শন, সৌন্দর্যচিন্তা, সমাজ ও
রাজনীতিচিন্তা, অর্থনীতি, পৌরনীতি, শিল্প-সাহিত্য সবকিছুতেই ছড়িয়ে আছে এর উপাদান। এবং
একইভাবে, যখন এই আধুনিকতার প্রকাশ কেন্দ্রিকতাকে পােক্ত করেছে; যুক্তি ও সত্যের ধ্রুবশর্ত নির্মাণ
করেছে; "আধুনিক' প্রতিষ্ঠানগুলি (যেমন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র) যখন একক শক্তিধর হয়েছে, তখন এর নানা
সলনকে যারা প্রশ্ন করেছেন, তাদের প্রকাশ-পদ্ধতিতেও উত্তর-আধুনিকতার উপাদান দেখা গেছে।
১৭২৬ সালে জোনাপন সুইফট এর গালিভার্স ট্রাভেলস প্রকাশিত হয়। তাতে সুইফটের একটি উদ্দেশ্য
ছিল: ইউরােপীয় সম্প্রসারণবাদের সমালােচনা। যুদ্ধ; রাষ্ট্রের ও তার বিদ্যাচর্চা প্রতিষ্ঠানের তােঘলকী
কর্মকাণ্ড, ব্যক্তির অহমিকা এসব কিছুই ছিল তার আক্রমণের বস্তু। তাঁর লেখায় প্যারডি, আয়রনির
পাশাপাশি একটি আত্মসমালােচনার প্রবৃতডিও ছিল। কিন্তু বড় কথা গালিভার্স ট্রাভেলস এর পুরাে বর্ণনাই
ছিল স্ব-বিদ্বংসী চিন্তায় পরিপূর্ণ। এই প্রবৃত্তিকে উত্তর-আধুনিকতার প্রবক্তারা খুব মূল্য দিচ্ছেন। সুইফট
তার এ মডেস্ট প্রপােজাল-এ ইংরেজদের ঔপনিবেশিকতাকে উদ্ভট একটি প্রস্তাবনার মাধ্যমে আক্রমণ
করেছিলেন। তিনি প্রস্তাব দিয়েছিলেন দরিদ্র, অপুষ্ট আইরিশ শিশুদের ইংল্যান্ডে রপ্তানি করা হােক,
তাদের ডিনার-টেবিলে খাদ্য হওয়ার জন্য। এতে আয়ারল্যান্ডের দুটো পয়সা আসবে, ইংরেজরাও
কুচিকর খাদ্য পারে। ইংরেজদের সমত্বে লালিত এবং চর্চিত যুক্তিবাদ ও আলােক-যুক্তিকালের
কল্যাণধর্মী চিন্তা এই অতিশয় উদ্ভট প্র্তাবনায় মুখ পুবড়ে পড়ল। এই কাজটি উত্তর-আধুনিক শিল্প-
সাহিত্য করে।
কিন্তু উত্তর-আধুনিক পদটিতে যে 'আধুনিক শব্দটি আছে, সেটি কোন আধুনিক? কোন অর্থে তা
আধুনিক? এই প্রশ্নটি এজন্য তােলা হয় যে, আধুনিকতা বলতে একটি বিশেষ চিন্তা, ধারণা বা
প্রকাশভঙ্গি বােঝায় না; আধুনিকতার আছে নানা তত্ব, নানা রূপ, নানা প্রকাশ। বদলেয়ারের
আধুনিকতার সঙ্গে অডেনের আধুনিকতার মল নেই; কামিল পিসারাে অথবা ক্লদ মনের আধুনিকতার
(অভিব্যক্তিবাদী) সঙ্গে পিকাসাের (ঘনত্ববাদী) অথবা, কাসিমির মালেভিচ (রাশিয়ান সুপ্রিমাটিস্ট)- এর
আধুনিকতার কোনাে মিল নেই-যদিও পকাসাে পিসারাে থেকে ৫০ বছর পরে জন্ম নিয়েছিলেন; মনে
থেকে মালেভিচের বয়স ছিল ৩৮ বছর কম। যে কেন্দ্রকে অস্বীকার করল উত্তর-আধুনিকতা, অথবা
সুবিধাপ্রাপ্ত ভাষা অথবা উচ্চতর ডিসকার্সকে, তা তৈরি হয়েছে আধুনিকতার নানা বয়ােঃক্রমে। তাহলে
একবচন-বাতিলকারী সেখানে আধুনিকতার ধারণাটাই বা কী করে একবচনীয় হয়?
কোন আধুনিকতাকে তা ভাঙছে? আর, উত্তর-আধুনিকতা যেখানে নিজেই একক-বিশিষ্টতার তিরােধা,
প্রশ্নের উত্তরে আমাদের একটু পেছনে যেতে হয় এবং আধুনিকতার তিনটি পর্যায়কে অর্গাৎ এ তিন
পর্যায়ের প্রবণতাগুলােকে একটু চিহ্নিত করতে হয়। শুরুতেই আমাদের মনে রাখত হবে আধুনিকতার
ইতিহাসটি, এবং এর বিকাশকালকে আমরা ইউরােপেই স্থাপন করি-আমাদের পছন্দ হােক বা না-
ই হােক। আধুনিকতার আধুনিক প্রকাশের একটি ধারাকে আমরা এশীয় অথবা উপমহাদেশীয় অগবা
বাংলাদেশী বলতে পারি, তাতে সমস্যা নেই। কিন্তু উৎপতির জন্য খুঁজতে হয় পশ্চিমের ভূমি ।
আধুনিকতার প্রথম পর্যায়টি ইউরােপীয় রেনেসাসের কালের। পঞ্চদশ শতকের ইতালিতে রেনেসাঁসের
আত্মপ্রকাশ (ইটালিতে কুয়াত্রচেন্তো-পঞ্চদশ--বলতে রেনেসাসকেই বােঝায়). ইংল্যান্ডে এর ঢেউ এসে
লাগে ষোড়শ শতকে। আমরা যদি ক্রিস্টোফার মার্লোর ডক্টর ফস্টাসকে রেনেসাঁস-চেতনার একটি
সফল ফসল হিসেবে দেখি, তাহলে প্রথমেই চোখে পড়বে ব্যক্তির উত্থান-সমষ্টি থেকে আলাদা হয়ে;
তার মনে প্রশ্নের সমারােহ: ঈশ্বরকেন্দ্রিক পৃথিবীর পরিবর্তে ব্যক্তিকেন্দ্রিক পৃথিবীর আত্মপ্রকাশ:
সৌন্দর্যচিন্তা এবং অনুসন্ধিৎসু মনের বিস্তার। মানুষের নবজাগ্রত প্রশ্নগুলােই শুরু-সপ্তদশ শতক থেকে
যুক্তিবাদী দর্শনে পরিণত হলাে, মানুষ তার জগৎ ও প্রকৃতিকে জানার চেষ্টা করলাে পদ্ধতিগত,
যুক্তিনির্ভর, ব্যবহারিক জ্ঞানের মাধ্যমে। এভাবে সৃষ্টি হলাে ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার, তত্ত্বের প্রাধান্যের এবং
যুক্তিতেই মুক্তি-এই ধারণার। কিন্তু প্রতিষ্ঠান যখন যুক্তিকে কাজে লাগাতে লাগলাে ব্যক্তিকে সমর্থনের
আড়ালে, তখন প্রতিষ্ঠানকে চ্যালেঞ্জ করাটা কঠিন হয়ে পড়লাে ব্যক্তির জন্য। আধুনিকতার এই পর্বে
তত্ত্ব, কেন্দ্রিকতা, অধিবিদ্যাসহ আরাে কিছু প্রবণতার সৃষ্টি হলাে।
দ্বিতীয় পর্যায়টি ছিলাে আঠারাে শতক থেকে সাড়ে উনিশ শতক পর্যন্ত। ইউরােপে শিল্পবিপ্লব সংঘটিত
হলে যন্ত্রের আগমন ঘটে, যন্ত্র আসলে যান্ত্রিকতা আসে এবং বস্তুগত উন্নয়ন ঘটে। দর্শনে ব্যক্তির উৎকর্ষ
সম্পর্কে একটি ধারণা জন্মাতে শুরু করলাে প্রধানত ভলতেয়ার, রুশাে, দদেরাে প্রমুখের লেখায় এবং
হাবেরমাসের ভাষায় 'এনলাইটেনমেন্ট প্রকল্পের অধীনে যুক্তির আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হলো, কিন্তু যুক্তির
আলাের নিচে অন্ধকার হিসেবে উপনিবেশবাদ এবং দাস ব্যবসার প্রসার ঘটতে থাকলাে। একদিকে
যুক্তির সর্বজনীনতা, মূল্যবােধের চূড়ান্ততা, উন্নয়ন ও বিকাশের (প্রােগ্রেস) এর পক্ষে রাষ্ট্র এবং বিবিধ
প্রতিষ্ঠান একত্র হলাে, কিন্তু অন্যদিকে জাঁ ফ্রাঁসােয়া লিওতা তাঁর 'পােষ্টমডার্ন কন্ডিশন : এ রিপাের্ট অন
নলেজ' গ্রন্থে যখন দেখিয়েছেন সংঘাত এবং ধ্বংসের অনিবার্য উপস্থিতি আধুনিকতার অভিজ্ঞতাকে
নড়বড়ে করে দিলাে। এই সংঘাত রাষ্ট্র করেছে ভিন্ন রাষ্ট্রের ওপর (ঔপনিবেশিকতা), প্রতিষ্ঠান করেছে
মানুষের ওপর (শিল্পকারখানা ও শ্রমিক শােষণ)।
উনিশ শতকের শেষার্ধ থেকেই আধুনিকতার তৃতীয় এবং সবচেয়ে জটিল পর্যায়টি শুরু। উনিশ শতকে
প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান নাড়া দিলাে প্রথা ও ঐতিহ্যসমর্পিত জীবনকে, বিজ্ঞান অরক্ষিত করে তুললাে বিশ্বাসকে
(বিশেষ করে ধর্মবিশ্বাসকে)। সামন্তবাদী প্রথা ও পুঁজিবাদকে প্রশ্নবিদ্ধ করলাে দান্ভিক ব্তবাদ।
নগরায়ন, বিচ্ছিন্নতা, প্রথম মহাযুদ্ধের বীভৎসতা, ব্যক্তির অসহায়ত্ব প্রবলভাবে দেখা দিলাে। এর প্রভাব
পড়লাে শিল্প-সাহিত্যে।
চলবে...
(সাজ্জাদ বিপ্লব সম্পাদিত স্বল্পদৈর্ঘ্য: 'উত্তর আধুনিক ভাবনা' সংখ্যার সৌজন্যে।)






x

No comments

Theme images by A330Pilot. Powered by Blogger.