মোনালিসা'র হাসি – মূর্ত ও বিমূর্ত || আশেক এলাহী || মানসলোক ||

 মোনালিসা'র হাসি – মূর্ত ও বিমূর্ত

~ আশেক এলাহী 




ইটালিয়ান চিত্রকর লিওনার্দো ভিঞ্চির (১৪৫২-১৫১৯) বিখ্যাত চিত্রকর্ম 'মোনা লিসা', যেটি এযাবৎ বিশ্বের সর্বাধিক প্রর্দশিত, আলোচিত এবং সর্বাধিক মূল্যমানের (৩৭৬১ কোটি) কালজয়ী অনুপম চিত্রকর্ম যাতে একজন রহস্যময়ী নারীর হাসিকে ভিজ্যুয়াল অপটিক্সের মাধ্যমে এমনভাবে তুলে ধরা হয়েছে দূর থেকে দেখলে মনে হয় হাসছে অথচ কাছে গেলে হাসিটা মিলিয়ে যাচ্ছে। আবার যে কোন এঙ্গেলে দেখা হোক না কেন মনে হয় অপলক দৃষ্টিতে দর্শকের দিকে তাকিয়ে আছে। মূল মডেল ইটালিয়ান নারী (লিসা গ্যারাদিনি) বাস্তবে যাই হোক শিল্পীর তুলিতে অসাধারণ ভঙ্গিতে পরিস্ফূত হয়ে উঠেছে। কবির কথায়, 

‘সেই সত্য যা রচিবে তুমি, ঘটে যা তা সত্য নহে, কবি তব মনভূমি ...’। 


আমরা জানি হাসিতে চারটি মাংসপেশী সক্রিয় থাকে, তার মধ্যে ‘জাইগোম্যাটিকাস মেজর’ – ঠোঁটের কর্ণারকে টেনে ধরে রহস্যময়তা ফুটিয়ে তুলে। এই মাসল চতুষ্টয়ের সঞ্চালনে মাত্র কয়েক ক্যালরি খরচ হলেও নিরবে নিক্ষিপ্ত এই মিসাইলে ধরাশায়ী হয় অনেক মহীরূহ, ঘটে অনেক আকাংক্ষিত প্রাপ্তি। প্রাচ্য-প্রতীচ্য সব শিল্প-সাহিত্যে পুরুষ অপেক্ষা নারীদের অঙ্গভঙ্গিমা নিয়ে বেশি আলোচনা হয়। কারণ আবেগ প্রকাশের ক্ষেত্রে নারীরা কোভার্ট (রহস্যাবৃত), ছেলেরা ওভার্ট (খোলামেলা)। একারণে কবি বলেন, 

‘নারীরা দোলক শুধু হাসি অশ্রু মাঝ, 

এই কাঁদে এই হাসে এই তার কাজ’। 


আমাদের প্রেম-বিরহের কবি নজরুল নিজের প্রেয়সীকে স্বখেদে বলেন, 

‘আকাশের মত তোমাদের চোখে সহসা বাদল নামে, 

রোদ্রের তাত ফুটে উঠে সখি সহসা সে মেঘ থেমে’। 


আলোচ্য চিত্রকর্মটিতে কোন প্রসাধনীর ব্যবহার স্পষ্ট নহে, এমনকি এ লাস্যময়ী নারীর ঠোটেও নেই কোন রঞ্জক বা লিপস্টিকের চিহ্ন, যা প্রসাধনী প্রস্তুতকারকদের হতাশ করার কথা। অথচ আটলান্টিকের এপারে বাঙ্গাল-মূলকে মহাকবি ‘আলাউল’ (১৬০৭-১৬৭৩) তার নায়িকা পদ্মাবতীর রূপসৌন্দর্য বর্ণনাকালে ঠোটকে রাঙাতে ভুলেননি। মধ্যযুগের কবিরা নায়িকাদের রূপ বর্ণনায় শুধু মুখের উপর ভর করেননি, যেমন পদ্মাবতীর বর্ণনায় –

‘সূচারু সুরস অতি রাতুল অধর,

লাজে বিম্ব বান্দুলি গমন বনান্তর।

রক্ত, উৎপল লাজে কালান্তর হৈশে,

তাম্বুল রাতুল হইল অধর পরশে’। 


আলাউলের কথায়, নায়িকার টুকটুকে লাল ঠোঁটের পরশে পান চিরদিনের জন্য লাল হয়ে গেল এবং রক্তিম বর্ণের মণিমুক্তারা লজ্জা পেয়ে পালিয়ে গেল। মধ্যযুগের কবিদের এ দারুণ ভঙ্গিমায় প্রকাশিত নারী সৌন্দর্য তৈলচিত্রে ধারণ করার মত কোন চিত্রশিল্পী হয়ত ছিল না, এ যুগের উপমহাদেশের খ্যাতনামা চিত্রশিল্পী ফিদা হাসান হয়ত বা তার তুলিতে ধারণ করতে পারতেন। 


এবার আনন্দ-বেদনার প্রকাশ ভঙ্গি নিয়ে দেশীয় প্রেক্ষাপটে কিছু আলোচনা করা যাক। বুকের মাঝে জমে থাকা আনন্দ বেদনার প্রবাহ প্রতিবিম্বিত হওয়ার কথা ‘মুখে’। মানব-মানবীর হাসি-কান্না নিয়ে সাহিত্যিকদের পদচারণা। আমাদের জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম যিনি দারিদ্রের কষাঘাত, প্রেম-বিরহের মর্মজ্বালা বুকে পুষেও হৈ-হুল্লোড়ে কাটানো জীবনে অভ্যস্ত ছিলেন, তার এ আপাতঃ উচ্ছাসের তলে কত বড় বেদনার সাগর লুকায়িত ছিল তা কিছু কিছু লেখায় প্রকাশ পেয়েছে। যেমন, 

‘তুমি বুঝিবে না আলো দিতে পুড়ে কত প্রদীপের প্রাণ’।।


‘'বড় কথা বড় ভাব আসে না মাথায়, 

বন্ধু গো বড় দুঃখে 

অমর কাব্য লিখিও তোমরা 

যাহারা আছো সুখে'’। 


অন্যত্র, সরাসরি বলেই ফেললেন, 

‘'হায়! তুমি বুঝিবে না !

হাসির ফূর্তি উড়ায় যে 

তার অশ্রুর কত দেনা''।  


মানবকুলের অভিব্যক্তির দ্বৈত রূপ আমরা প্রাচূর্যে লালিত আপাত গাম্ভীর্যে ভরা ঋষি কবি রবিঠাকুরের লেখাতেও পাই। যেমন, 


'‘আমারে পাছে সহজে বুঝ 

তাইত এত লীলার ছল, 

উপরে যার হাসির ছটা 

ভিতরে তার চোখের জল’'। 


এ চোখের জল পরিমাপযোগ্য নয়। একথা স্পষ্ট যে অনেক সময় আমাদের বাহ্যিক মুখায়বে যে অভিব্যক্তি ফুটে উঠে তা মনের বার্তাকে প্রতিফলিত করে না। আমাদের আলোচ্য চিত্রকর্মের '‘মোনা লিসা'’র এ রহস্যময় হাসিকে অনেক সমালোচক বলেছেন, এটি হাসি নয়, হাসির ভঙ্গিতে শ্লেষ!! এ রম্য আলোচনার ইতি টানছি রবীন্দ্রনাথের সোনার তরীর 'হিং টিং ছট' কবিতার প্যারোডি দিয়ে -  


"এসো ভাই তোলো হাই শুয়ে পড় চিত, 

অনিশ্চিত সংসারে এ কথা নিশ্চিত; 

হাসিকান্নার অভিনয় এজগতে হায়, 

সকলি মিথ্যা সকলি মায়াময়। 

অভিজ্ঞজনের কথা অমৃত সমান,

গৌরানন্দ কবি হলেন শুনে পূণ্যবান"।।


লেখক: কবি ও চিকিৎসক 

No comments

Theme images by A330Pilot. Powered by Blogger.