রব্বানী দৃষ্টিতে সুফি || বাপ্পা আজিজুল || মানসলোক ||


 রব্বানী দৃষ্টিতে সুফি 

বাপ্পা আজিজুল


যারা ইলমে তাসাউফের চর্চা করেন তাদের সুফি বলা হয়। সুফি বলতেই কী বিভ্রান্ত? সমকালীন ও অগ্রজ সুফিদের শিক্ষা ও জীবনাচরণ পর্যালোচনা করে ৩ ধরণের সুফির হদিস পাওয়া যায়-

১. খালেস সুফি

২. নিম সুফি

৩. গায়রে সুফি


খালেস বা নির্ভেজাল সুফি তারাই যারা শরিয়তের পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসরণ করে। কুর'আন, হাদিসে বর্ণিত রাসুল সা. এর দেখানো পথ-পদ্ধতি অনুসারে কোন বিশেষ কায়দা-কানুন ছাড়াই তাযকিয়ায়ে নফসের অনুশীলন করে। নিম বা আধা সুফিদের নিয়ত তাযকিয়া নফস হলেও তারা সহিহ পদ্ধতির সাথে গ্রেকো-রোমান, জরথ্রুস্ট, ভারতীয় প্রভৃতি দর্শন ও আচারের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে নতুন নতুন তত্ত্ব ও পরিভাষা তৈরি করেছে, এতে যুক্ত হয়েছে শিরক ও বিদাত। বলা বাহুল্য, গায়রে সুফিরা ধর্ম বাদ দিয়ে সেক্যুলার বিভিন্ন রীতি-নীতি, নাচ-গান সর্বস্ব হয়ে বসে আছে। যুহদ ত্যাগ করে শাহেনশাহী জীবন যাপন করছে। এদের অনেকে আবার শরিয়তকেও অস্বীকার করে। নারী-পুরুষ আওরাতের ধার ধারে না।


অতীতের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যায়, আব্বাসীয় যুগে দর্শন ও কালামশাস্ত্রের মতো তাসাউফও সত্য থেকে অনেক দূরে সরে যায় এবং ইবনে তাইমিয়ার যুগের পূর্বেই তা ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছে। হিজরি ২য় শতকে, আদিপর্বে, এটি ছিল কেবল আত্মশুদ্ধির উপায় (তাযকিয়াতুন নফস)। ইবরাহিম ইবনে আদহাম (মৃত্যু ১৬০/৭৭৬), ফুদায়েল ইবনে ইয়াদ (মৃত্যু ১৮৭/৮০৩) প্রমুখ সুফিরা খুব অনাড়ম্বর জীবন যাপন করতেন এবং ইবাদাত ও জিকিরে মশগুল থাকতেন। ৩য় শতকে তাদের উত্তরসূরিরা, যেমন আবু ইয়াজিদ (মৃত্যু ২৬১/৮৭৫), জুনায়েদ (মৃত্যু ২৯৮/৯১০) এবং অন্যরা, আল্লাহর নৈকট্য হাসিলের জন্য তাদের নিজস্ব তরিকা তৈরি করেন। তারা বিভিন্ন স্তর ও পদমর্যাদা ঠিক করেন এবং আল্লাহর সাথে সম্পর্কের চূড়ান্ত কিছু পর্যায় যেমন, ফানা- আত্মবিলোপ ও জাম-আল্লাহ বা পরম সত্তার সাথে একীভূত হওয়া ইত্যাদির প্রবর্তন করেন। সুফিরা যেসকল অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যায়, তারা সেগুলোর পরিভাষা নির্ধারণ করে। বিশেষত আস-সারাজ (মৃত্যু ৩৭৮/৯৮৮) ও আল-কুশাইরি (মৃত্যু ৪৮৫/১০৭২) তাদের কর্মসমূহে এসব বর্ণনা করেছেন। সুফিবাদের এই পর্বে আমরা আদিপর্বের চেতনা ও অভিজ্ঞতার কিছুটা বর্ণচ্ছটা দেখতে পাই, যেমনটি জুনায়েদের তাওহিদ বিষয়ক আলোচনা কিংবা আবু ইয়াজিদের নিজস্ব অভিজ্ঞতার বর্ণনায় পাওয়া যায়। 

৩য় ও শেষপর্বে তাসাউফ, দর্শনের দৃষ্টিকোণ থেকে সেটির নিগূঢ় অভিজ্ঞতার বয়ান তৈরি করতে থাকে, যা আমরা দেখতে পাই আল-হাল্লাজের (মৃত্যু ৩০৯/৯২৩) ‘হুলুল’ তত্ত্বে- মানুষের মধ্যে আল্লাহর বাস- কিংবা ইবনুল আরাবির (মৃত্যু ৬৩৮/১২৪০) ‘ওয়াহাদাত আল-উজুদ’- সত্তার মিলন- তত্ত্বে। ইবনুল আরাবি, যিনি নিজেও দামেশকে অবস্থান নিয়েছিলেন একসময়, ও ইবনে তাইমিয়ার মধ্যে এক শতাব্দীরও কম ব্যবধান ছিল। এই অল্প সময়ের মধ্যে ইবনুল আরাবির তত্ত্বটি পুরো ইসলামি বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন সুফিরা যেমন- আল-কুনাবী (মৃত্যু ৬৭২/১২৭৩), ইবনে সাব’ইন (মৃত্যু ৬৬৮/১২৬৯), আল-তিলিমসানি (মৃত্যু ৬৯০/১২৯১) এবং অন্যান্যরা এর আবার বিভিন্ন সংস্করণও তৈরি করে ফেলে। হিজরি পঞ্চম শতকের গোড়ার দিকে, আল-গাজালি (মৃত্যু ৫০৫/১১১১), তাঁর লেখা মিশকাতুল আনোয়ার গ্রন্থে সরাসরি, ইহইয়া আল-উলুমুদ্দিন ও অন্যান্য লেখায় প্রচ্ছন্নভাবে একটি সুফিবাদি দর্শনের জন্ম দেন যা অনেকটা ইবনুল আরাবির ধারণার কাছাকাছি। লেখাগুলোতে তিনি বিভিন্ন ধর্মীয় বিষয়ে যেমন তাওহিদ, তাওয়াক্কুল, সবর, ভালোবাসা (মুহাব্বত) ইত্যাদির সুফি ঘরানার ব্যাখ্যা দেন। তিনি দৃঢ়ভাবে সুফি তরিকা সমর্থন করেন এবং চূড়ান্ত বাস্তবতা ও ধর্মতাত্ত্বিক সত্য অনুধাবনের জন্য কাশফের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে জোর দেন। 


তাসাউফ সম্পর্কে তৈরি হওয়া এইসব মতামত একজন মুজাদ্দিদের জন্য খুবই আপত্তিজনক। প্রথমে তাঁর উচিত ছিল ধর্মতত্ত্ব ও দ্বীন ইসলামে এবং ওহি ও যুক্তিতে কাশফের স্থান কোথায় তা নির্ধারণ ও যাচাই করা। দ্বিতীয়ত, সুফিবাদ ধর্মতত্ত্ব ও দর্শনের আলোকে যে তত্ত্ব দাঁড় করিয়েছে, সেগুলোর যৌক্তিকতা, শুদ্ধাশুদ্ধি নির্ণয় করা দরকার ছিল। তৃতীয়ত, সুফিরা যে সুলুকের বয়ান করে তা কতটুকু কুরআন-হাদিসের নিক্তিতে সামঞ্জস্যপূর্ণ তা নিরীক্ষণ করা। চতুর্থত, সুফিরা জীবনের যে মূল্যবোধ গড়ে তুলেছে এবং ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধের যে ব্যাখ্যা দিয়ে থাকে সেগুলোর কতটুকু গ্রহণযোগ্য, কতটুকু পরিত্যাজ্য সেটিও তাঁর খতিয়ে দেখা উচিত ছিল। 


কয়েক শতাব্দী ধরে সুফিরা তাদের নিজস্ব ধারায় (তরিকত) কাজ করে চলেছে। তারা নিজস্ব সুলুক বিনির্মাণ করেছে। তারা রাসুলুল্লাহর সুলুক থেকে অনেক কিছু গ্রহণ করেছে, কিন্তু বহু কিছু যোগ ও উদ্ভাবন করেছে। ইবনে তাইমিয়া এর মধ্যে দুটি বিষয়কে উল্লেখ করেছেন। একটি হলো ‘খালোয়াহ’র চর্চা করা, জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পর্বত গুহা কিংবা বন-বাদাড়ে নির্জন বাস; আরেকটি হলো একটি নির্দিষ্ট সময় নির্জনবাস কিংবা উপাসনা করার জন্য- যেমন চল্লিশ দিন- জাবিয়্যাহ বা খানকাহ নির্মাণ করা। সুফিরা এই অনুশীলনকে খুব উচ্চ মর্যাদা দান করে এবং রাসুলুল্লাহ সা. এর নবুয়তের প্রাক্কালে হেরাগুহায় অবস্থানকে দলিল হিসেবে পেশ করে। ইবনে তাইমিয়া অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে বলেন, এটি বিদআত। অমূলক উদ্ভাবন।  মূলনীতি হলো- রাসুলুল্লাহ সা. এর নবুয়তপূর্ব জীবনের কোন কর্ম সুন্নাহ হিসেবে প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট নয় এবং তা অনুসরণ করা জরুরি নয়। এটি অবশ্যই প্রণিধানযোগ্য যে, পরবর্তী সময়ে পুরো নবুয়তী জিন্দেগীতে রাসুল সা. হেরা গুহাতে যাননি। এমনকি অন্যকোন গুহাতেও যাননি কিংবা যাওয়ার বাসনা ব্যক্ত করেননি। অধিকন্তু, তাঁর কোন সাহাবি তাঁর জীবদ্দশায় কোন গুহাতে অবস্থান করার পুনর্বিবেচনা করেননি। যদি এর মধ্যে প্রত্যাশিত কিছু থাকত, তবে রাসুল সা. তাঁর অনুসারীদের অবশ্যই তা করতে নির্দেশ দিতেন। 

দ্বিতীয় যে বিষয়টি ইবনে তাইমিয়া শক্তভাবে দ্বিমত পোষণ করেন, তা হলো সুফিদের জিকিরের রসম-রেওয়াজ। তিনি বলেন, রাসুল সা. যেসমস্ত জিকির শিখিয়ে গেছেন, তা সবই হাদিসে সংরক্ষিত আছে এবং সেগুলো অর্থবহ বাক্য। সেখানে শুধু ‘আল্লাহ’ কিংবা ‘হু’ সর্বনাম উচ্চারণ করে কোন জিকিরের অস্তিত্ব নেই। এধরণের কোন জিকির রাসুলুল্লাহ কিংবা তাঁর সাহাবিদের সূত্রে বর্ণিত হয়নি। সুফিদের এই জিকিরের প্রচলন সম্পূর্ণ বিদআত এবং ভ্রান্ত। আল-গাজালিও এখানে ভুল করেছেন, যখন তিনি বলেন- ‘লা ইলাহা ইল্লালাহ’ হলো আমজনতার জিকির আর শুধু ‘আল্লাহ’ অভিজাত শ্রেণির জিকির। 

সুফি সুলুকের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো ‘ফানা’। ইবনে তাইমিয়া ভালোই জানতেন যে, এটি নববি সুলুকের অংশ। পরবর্তী যুগের সুফিরা যেমন- ভারতবর্ষের শেখ আহমদ সিরহিন্দি (মৃত্য ১০৩৪/১৬২৪) এবং শাহ ওয়ালী উল্লাহ (মৃত্যু ১১৭৬/১৭৬২) দ্ব্যররথহীন ভাষায় বলেছেন, এগুলো রাসুলুল্লাহর তরিকার অংশ নয়, কখনও ছিলো না।২৩ ইবনে তাইমিয়া যদিও বিষয়টিকে সরাসরি বিদআত বলেননি, তিনি শুধু আপত্তি জানিয়েছেন এজন্য যে, আবদুল্লাহ আল-আনসারি আল-হাওয়ারি’র (মৃত্যু ৪৮১/১০৮৮) মতো একজন সুফি যখন এই অভিজ্ঞতাকে সুলুকের মূল লক্ষ্য হিসেবে দাবি করেছে। অথবা যখন ইবনুল আরাবী সত্তার একীভূত তত্ত্ব ‘ওয়াহাদাত আল-উজুদ’। 

ইবনে তাইমিয়া অত্যন্ত কড়া ও প্রবলভাবে তাসাউফের যে তত্ত্বটি সমালোচনা করেছেন তা হলো- ‘ওয়াহাদাত আল-উজুদ’। ইবনুল আরাবীর ব্যাখ্যা মতে, তত্ত্বটি দুটি দত্তবাক্যের উপড় প্রতিষ্ঠিত। প্রথমত, কোন বস্তুর সারসত্তা সেটির অস্তিত্ব থেকে আলাদা এবং এটি শুধু একটি অনস্তিত্ব নয়, বরং কোন কিছু গুণসম্পন্ন হয়ে অস্তিত্ব লাভের আগে এটি বিদ্যমান। দ্বিতীয়ত, আল্লাহর অস্তিত্ব, মহাবিশ্বের অস্তিত্বের সম্পূরক।২৫ ইবনে তাইমিয়া দুটি তত্ত্বই বাতিল বলে খারিজ করে দেন। আমরা আগেই উল্লেখ করেছি তিনি একজন পুরোদস্তুর সংজ্ঞাবাদী। সুতরাং অস্তিত্বলাভের আগে সারসত্তার বিদ্যমান থাকা বিষয়টি প্রকৃত বাস্তবতার আলোকে খণ্ডন করা তাঁর জন্য কঠিন কিছু নয়। এনং মহাবিশ্বের অস্তিত্বলাভের সাথে আল্লাহর অস্তিত্বলাভকে অভিন্ন বলা তত্ত্বটিও তিনি অনায়াসে যুক্তি দিয়ে বাতিল গণ্য করতে পারেন। তিনি কোনকিছু পরম অস্তিত্ব কিংবা স্বগত অস্তিত্ব হিসেবে থাকার মূলনীতিটি প্রত্যাখ্যান করেছেন। কোন কিছুর অস্তিত্বলাভ করা সেই বস্তুটির একান্ত নিজস্ব, একটি বস্তুর অস্তিত্ব লাভ মানে অন্য বস্তুর অস্তিত্বলাভ নয়। আল্লাহর অস্তিত্ব মানে আল্লাহরই অস্তিত্ব, মহাবিশ্বের অস্তিত্ব মানে সেটিরই অস্তিত্ব। একটি আরেকটির সম্পূরক বা অভিন্ন নয়। কোন বস্তুর স্বগত অস্তিত্ব শুধুমাত্র মনোজগতের চিন্তা, বাস্তব নয়। 

আরেকটি প্রেক্ষিতে ইবনে তাইমিয়া ‘ওয়াহাদাত আল-উজুদ’র বিরোধিতা করেন, সেটি হলো দ্বীনের অপূরণীয় ক্ষতি করেছে তত্ত্বটি। পরিণামে আমাদের নৈতিকতা, জীবন এবং দ্বীন অনুসৃত অন্যান্য বিষয়গুলো ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, এটি বলছে- আল্লাহর গুণাবলী বাস্তব নয়, কেবল আপেক্ষিক; আল্লাহ তায়ালার অনিবার্যতা থেকে মহাবিশ্বের যাত্রা শুরু হয়েছে, তাঁর ইচ্ছায় সৃষ্টি হয়নি, মানুষের নিজের কোন ইচ্ছা নাই, তার কর্ম সে নিজে করে না, আল্লাহ কর্তৃক সম্পাদিত হয়। আল্লাহই বিশ্বাস করেন, অবিশ্বাস করেন, সৎকর্ম করেন, মন্দকাজও করেন। তিনি নিজেই বন্দনা করেন এবং বন্দনাপ্রাপ্ত হন। তিনি নিজেই হত্যা করেন এবং নিহত হন। কোন কিছুই নিজে থেকে ভালো কিংবা মন্দ নয়। বিশ্বাস এবং অবিশ্বাস আলাদা কিছু নয়, তেমনি তাওহিদ এবং শিরকও একই। মূর্তিপূজা বা অন্য দেবদেবীর পূজা করা আল্লাহর ইবাদত করারই নামান্তর, যেহেতু আল্লাহ ছাড়া আর কারও অস্তিত্ব নেই। এক আল্লাহর ইবাদত করার জন্য নবিদের দাওয়াত প্রদান ছলনা মাত্র, যেহেতু আল্লাহ ছাড়া আর কোন খোদার অস্তিত্ব নেই। জাহান্নাম আযাবের জায়গা নয়, উপভোগের স্থান। জান্নাতের আমোদ-প্রমোদ থেকে এর ধরণ আলাদা। 

কিছু কিছু সুফি, তাদের অভিজ্ঞতার আলোকে, তারা কাশফে যে ধারণা লাভ করে, বা যে ক্ষমতা লাভ করে, তারা দাবি করে তাদের ওয়ালায়াত, নবিদের ওয়ালায়াত থেকে শ্রেষ্ঠতর। অর্থাৎ ওলিরা নবির চেয়ে শ্রেষ্ঠতর। তারা আরও বলে, নবিদের সীলমোহরের ন্যায় ওলিদেরও সীলমোহর আছে। ইবনে তাইমিয়া এই ধারণাকে নিরীক্ষণ করেন এবং দেখান এগুলো অসত্য। কোন ওলিই নবির চেয়ে শ্রেষ্ঠ নয়। কোন ওলিই নবিদের ন্যায় ওহি কিংবা হেদায়েতপ্রাপ্ত নয়। একজন মানুষ আল্লাহর অলিত্ব অর্থাৎ ‘বন্ধুত্ব ও সমর্থন’ লাভের জন্য দুটি জিনিস অর্জন করা জরুরি- আল্লাহর উপর বিশ্বাস এবং নবির আনুগত্য। অর্থাৎ যার আল্লাহর উপর অবিচল বিশ্বাস আছে এবং রাসুল সা.কে পরিপূর্ণ অনুসরণ করে। কোন সুফির তরিকা অনুসরণ করা, অলৌকিক অভিজ্ঞতা অর্জন করা, কাশফ দেখা, কারামত দেখানো জরুরি নয়। আল্লাহর অলিত্ব সবার জন্য উন্মুক্ত। সে একজন কৃষক, ব্যাবসায়ী, আলিম, মুজাহিদ কিংবা শাসক, যে-ই হোক। 

ইবনে তাইমিয়া সুফিদের দেয়া ‘যুহদ’ ও ‘ইশক’, ‘আস্থা’ ও ‘রিয়া’ প্রভৃতি শব্দের ব্যাখ্যাও বিস্তারিত পর্যালোচনা করেন। তিনি দেখান এর কতটুকু কুরআন, সুন্নাহ, সালাফদের অনুশীলন ও হাদিস দ্বারা সমর্থিত এবং কতটুকু তাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতা ও ধারণাপ্রসূত। তাঁর পূর্বে ইবনে আল-জাওযীও (মৃত্যু ৫৯৭/১২০০) ‘তালবিস ইবলিশ’ গ্রন্থে একইরকম পর্যালোচনা করেন। ইবনে তাইমিয়া তাঁকেও ছাড়িয়ে যান এবং আরও বিস্তর ব্যাখ্যা করেন। বিশেষ করে, কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ইতিবাচক দিকগুলো আলোকপাত করেন। পরবর্তীকালে তাঁর ছাত্র ইবনুল কাইয়্যিম (মৃত্যু ৭৫১/১৩৫০) ‘মাদারিজুস সালেকীন’ ও অন্যান্য গ্রন্থের মাধ্যমে কাজটি পান্ডিত্যের সাথে এগিয়ে নিয়ে যান (আনসারি, ২০০৫)।


গায়রে সুফিদের ব্যাপারে ইমাম মালিকের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। এক ব্যক্তি তাঁকে জানালেন, "আমাদের কয়েকজন প্রতিবেশী পেট পুরে খায়, কবিতা আবৃত্তি করে। আবৃত্তির তালে তালে নাচে আর নিজেদের সুফি দাবি করে! তারা শুধু খাওয়া-দাওয়া, কবিতা আবৃত্তি আর নাচ-গান করেই ক্ষান্ত হয় না; বরং সময়ে-অসময়ে মুর্ছা যায়। একে অন্যের গায়ে ঢলে পড়ে।" ইমাম মালিক জিজ্ঞেস করলেন, তারা কি শিশু? লোকটি বললেন, না। "তবে তারা কি পাগল?" লোকটি জানালেন, না। পাগল তো নয়। ইমাম মালিক বললেন, "আজ পর্যন্ত কোনো মুসলিম এমন করেছে বলে আমার জানা নেই"। 


প্রচলিত সুফি বর্ণনানুসারে, ইলমে তাসাউফের উৎপত্তির উৎসমুখ যদি আমরা আসহাবে সুফফার জ্ঞানচর্চাকে ধরি, তাহলে তাদেরকে আমরা খালেস হিসেবেই পাই। তাঁরা শরিয়তের পরিপূর্ণ পাবন্দী করেছেন। জ্ঞানার্জন ও বিতরণ করেছেন। নির্লোভ ও দুনিয়াবিমুখ ছিলেন কিন্তু রাসুল সা. এর আহ্বানে সাড়া দিয়ে কিতাল ফি সাবিলিল্লাহতে অংশ নিতে পিছপা হননি কেউ। অনেকের মতে, হাসান বসরি রহ. ছিলেন প্রথম যুগের তাবেঈ সুফি। কিন্তু তাঁর জীবন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, তিনি ছিলেন তৎকালীন সর্বাধিক প্রজ্ঞাসম্পন্ন মুজতাহিদ ইমামদের একজন। তাঁর বর্ণিত করা অধিকাংশ হাদিস পরকাল বিষয়ক। তিনি প্রয়োজনে নির্জনবাস করলেও সার্বক্ষণিক ছাত্রবেষ্টিত থেকে শিক্ষাদান করেছেন, বিভিন্ন মেয়াদে শহরের কাযীর দায়িত্ব পালন করেছেন। খলিফাদের দরবারে গিয়ে হককথা বলেছেন, পরামর্শ দিয়েছেন। মুজাহিদ, আতা, তাউস প্রমুখ তাবেঈ তাঁর দারসে বসেছেন। ইবনে খাল্লিকান বলেন, তাঁর মাঝে ইলম,আমল, তাকওয়া ও দুনিয়াবিমুখতার অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছিল। ইমাম যাহাবি বলেন, হাসান বসরি মানুষকে হৃদয়গ্রাহী ভাষায় উপদেশ দিতেন। সকল প্রকার কল্যাণকর কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতেন।... ভাষার বিশুদ্ধতা ও অলংকারময়তায় প্রবাদপুরুষ, শক্তি-সাহসে অদম্য বীর। ১ম যুগের অন্যান্য সুফি যেমন- ইবরাহিম ইবনে আদহাম, মারুফ কারখী কেউ নতুন তরিকা আবিষ্কার করেননি, বরং কুর'আন-সুন্নাহকেই তারা প্রাধান্য দিয়েছেন। 


পরবর্তী যুগে ইমাম গাজালিকে আমরা একজন মুজাদ্দিদ ও সুফির দ্বৈত ভূমিকায় দেখতে পাই। কুর'আন-সুন্নাহ ভিত্তিক তাসাউফ চর্চাকে তিনি পুনর্প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়া ভারতীয় উপমহাদেশেও মুজাদ্দিদে আলফেসানি (আহমদ সিরহিন্দ), শাহওয়ালী উল্লাহ দেহলভী রহ. প্রমুখ সুফিদেরও সক্রিয় মুজাদ্দিদ এবং মুজাহিদ হিসেবে ময়দানে ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়। 


আমরা লক্ষ্য করেছি, ইবনে তাইমিয়া ওহি ও যুক্তির বাইরেও জ্ঞানের আরেকটি উৎসকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন, যদিও তিনি সুফিদের কাশফ এবং অলৌকিক অভিজ্ঞতার সাথে সেটি কিভাবে সাযুজ্য হবে তা বিস্তারিত বলেননি। তিনি এটির পরিসরকে সীমিত করেছেন এবং প্রত্যাদেশের সাথে প্রাসঙ্গিক করেছেন। সুফিবাদ নিয়ে ইবনে তাইমিয়ার সমালোচনার ১ম ক্ষেত্র হলো বিভিন্ন তত্ত্ব, যেমন- হুলুল তত্ত্ব, মানুষের মধ্যে আল্লাহর বসবাস এবং ওয়াহাদাত আল-উজুদ। বিশেষ করে তিনি শেষোক্তটি সম্পর্কে বিস্তারিত সমালোচনা করেছেন। যে দত্তবাক্যের উপর এটি তৈরি হয়েছে সেটিকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছেন এবং ইসলামি আকিদা ও মূল্যবোধে এটির সকল কুপ্রভাবকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। এরপর তিনি সুফিদের মনগড়া তরিকাকে পর্যালোচনা করেছেন এবং ইবাদাত ও যিকরের নামে তাদের অননুমোদিত উদ্ভাবনের (বিদআত) নিন্দা করেছেন। ইসলামি জীবনে তাদের এই অনুশীলনের অবাস্তবতাকে তিনি তুলে ধরেছেন। তবে এখানে উল্লেখ্য যে, তিনি সুফিদের ফানার অভিজ্ঞতাকে এইভাবে সমালোচনা করেননি, ফানা- একজন সাধারণ সাধক (জাহিদ) ও ইবাদতকারীর (আবিদ) অভিজ্ঞতা থেকে আলাদা। তিনি সুফিদের দেয়া বিভিন্ন শব্দের আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা যেমন সংযম, ভালোবাসা, আস্থা, ইখলাস, তাওয়াক্কুল ইত্যাদির সমালোচনা করেন এবং এদের মধ্যে কতটুকু সত্য-মিথ্যা আছে তা বের করে দেখান। তিনি সেগুলো কুরআন, হাদিস এবং সালাফদের অনুশীলনের আলোকে বিস্তারিত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেন। আকিদার বিষয়ে যুক্তি কিংবা কাশফ নির্দিষ্ট জ্ঞান দান করতে পারে না। একমাত্র নবিদের ওহিই হল বিশুদ্ধতম উৎস। 


তবে কাশফকে এক কথায় উড়িয়ে দেয়া যায় না। বিজ্ঞানের উন্নতির যুগে আমরা কাশফকে বিস্তর অধ্যয়নের সুযোগ পাই। প্যারা-সাইকোলজির জ্ঞানানুসারে কাশফের অভিজ্ঞতা Extra sensory perception (ESP) হিসেবে গণ্য করতে হবে। আরবিতে বলা হয় ইদরাক লা হিস্যি। প্যারা-সাইকোলজিতে দুটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত- ESP ও psychokinesis. মনোবিজ্ঞানীরা টেলিপ্যাথি, ক্লেয়ারভয়েন্স ও প্রিকগনিশকে ESP হিসেবে অভিহিত করছে। এ বিষয়ে আরও উত্তরোত্তর গবেষণা চলছে যার ফলে অদূর ভবিষ্যতে আরও অনেক ব্যাপার খোলাসা হয়ে যাবে। কুর'আন ও সুন্নাহতে বর্ণিত ইলহাম, হাদাস (স্বজ্ঞা বা intuition, উমার রা. হাদাসপ্রাপ্ত হওয়ায় তাকে উম্মাতের মুহাদ্দাস বলা হয়। যার স্থান নবুয়তের পরেই), জিবিল্লাত (উপজ্ঞা, instinct), খেয়াল বা কল্পনা ইত্যাদি সবই ESP। এমনকি ওহিও একটি বিশেষ ধরণের ESP। টেলিপ্যাথির উদাহরণ হিসেবে উমার রা. এর বিখ্যাত ঘটনাটি সর্বজনবিদিত। তিনি মদিনায় মসজিদে নববিতে বসে চিৎকার কঅরে দূরবর্তী স্থানে যুদ্ধরত বাহিনীর কমান্ডারকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিলেন। কামান্ডার নির্দেশটি শুনতে পেয়ে যথাযথ বাস্তবায়ন করল এবং যুদ্ধে জয়লাভ করল (ওমর কাসুলি, ২০০০)।


আবার মনোবিদ Carl Jung এর মতে মানব মনকে ৩টি স্তরে ভাগ করা যায়- চৈতন্য, ব্যক্তিগত নির্জ্ঞান মন, সামষ্টিক নির্জ্ঞান মন। সংবেদন সজ্ঞান মনে বিরাজমান আবেগ, অনুভূতি, চিন্তা বিভিন্ন কারণে অবদমিত হলে তারা নির্জ্ঞান মনে অবস্থান নেয় এবং স্বপ্ন ও কল্পনায় তাদের আবির্ভাব-তিরোধান ঘটে। Jung আরও বলেছেন, আমাদের মন ৪টি পন্থায় কাজ করে- মনন, অনুভূতি, সংবেদন ও বোধি। বোধির সংজ্ঞা হল- সেই মানসিক ক্রিয়া যা প্রত্যক্ষ জ্ঞানকে নির্জ্ঞান মনের স্তরে পাঠিয়ে দেয়। এখানে প্রেরণ করা মুখ্য নয়, প্রত্যক্ষ জ্ঞান ও নির্জ্ঞান মনের  অবস্থাটাই মুখ্য। বোধি সক্রিয় ও নিষ্ক্রিয় উভয়ই হতে পারে।  মানব মনে বোধি প্রধান কার্যকরী শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হলে মানুষ সৃজনশীল, কল্পনাপ্রবণ ও মরমী হয়ে ওঠে। বলা বাহুল্য, শিল্পী, কবি ও সুফিদের মধ্যে এই ম্যাকানিজমটিই ক্রিয়াশীল। Jung এর ধারণা স্বীকার করলে এটিই প্রতিভাত হয় যে, মানব মনের একটি বিশেষ শক্তি আছে যা প্রত্যক্ষ জ্ঞান বা পঞ্চেন্দ্রিয় ছাড়াই অর্জন করা যেতে পারে, আবার প্রত্যক্ষ জ্ঞানেরও রয়েছে প্রচুর শক্তি। তাহলে ওহি বা প্রত্যাদেশ কোন অবৈজ্ঞানিক প্রপঞ্চ নয়। নবি মুহাম্মদ সা. মানব সমাজের মুক্তির জন্য দীর্ঘদিন যে চিন্তাগুলো করেছিলেন, তা-ই জমা হয়েছিল তাঁর নির্জ্ঞান মনের স্তরে বোধি আকারে। সে নির্জ্ঞান মনের কার্যকারিতায় তিনি প্রত্যাদেশ লাভ করেন। এর প্রমাণ তাঁর সিরাত থেকে পাওয়া যায়, জীবনঘনিষ্ঠ কোন বিষয়ে তাঁকে কেউ প্রশ্ন করলে উত্তর জানা না থাকলে তিনি সাথে সাথে জবাব দিতেন না। প্রত্যাদেশের অপেক্ষায় থাকতেন। এসময় তাঁর বোধি প্রশ্নগুলোকে নির্জ্ঞান মানসে ঠেলে দিত, এবং সেখানে প্রশ্নগুলোর উত্তর তৈরি হলেই কেবল তিনি উত্তর দিতেন। এতে অবশ্য ওহি নাযিলের সবগুলো পদ্ধতি ব্যাখ্যা করা যায় না, যেমন- ফেরেশতা নাযিল হওয়া। তবে এটি অসম্ভব নয় যে, বোধির কার্যকারিতা ফলে বিষয়গত দিকে (objective side) ফেরেশতা হাজির হতেই পারেন (আজরফ, ২০০৬)। 


তাই একজন রব্বানী সুফিদের একবাক্যে খারিজ করতে পারেন না। তিনি সুফিদের ব্যাপারে পর্যালোচনামূলক অবস্থান গ্রহণ করবেন। খালেস সুফিদের ব্যাপারে ইতিবাচক ধারণা পোষণ করবেন। তাদের জ্ঞান, চর্চা ও অভিজ্ঞতা থেকে উপকৃত হবেন। 

No comments

Theme images by A330Pilot. Powered by Blogger.